আজকের সম্পাদকীয় বিষয়ের কারণে একটু দীর্ঘ হবে। যে কজন পাঠক কষ্ট করে আমার লেখা এখনও পড়েন, তারা ধৈর্য্য নিয়ে শেষ করবেন আশা করছি।
শেখ হাসিনা যে বাকশালের পথেই হাঁটবেন (ইতর মহিলাকে আর আপনি সম্বোধন করা যায় কিনা এ নিয়ে দ্বিধায় থাকলেও স্বভাব ও রীতি অনুযায়ী আজও করলাম) সেটা ২০০৮ সালের মার্কিন-ভারতের যৌথ মদদে, বাংলাদেশের মেরুদন্ডহীন, দেশপ্রেমবিবর্জিত, আত্মসুখে বিভোর, সুবিধাবাদী, লড়াইবিমুখ, সেনাবাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে ডিসেম্বরের সাজানো নির্বাচনের মাসখানেক আগেই আমার দেশ পত্রিকায় মন্তব্য-প্রতিবেদন কলামে খোলাসা করেই লিখেছিলাম। ২০১১ সালে প্রথম বারের কারা বন্দিত্বের কালে, একুশে বইমেলায় “নবরূপে বাকশাল” নামে লেখা আমার তৃতীয় বইটি প্রকাশিতও হয়েছিল। এই শতকের বাকশাল যে মুজিবের প্রথম দফার চেয়ে অনেক দীর্ঘায়িত হবে তাও উল্লেখ করেছিলাম। বিপদ বোঝা তো দূরের কথা, সেই সব লেখা পড়ারই সময় বিরোধী শিবিরের নেতাকর্মীদের হয় নাই। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে সত্যজিত রায় তার অনন্যসাধারণ রচনাশৈলীতে বলে গেছেন না, “জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই”। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, যুগান্তকারী ঐ বাক্যই আমাদের জন্য স্বত:সিদ্ধ।
আঠারো ও উনিশ শতকের বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের কলকাতায়, সম্পূর্ণ হিন্দু আচার ও সংস্কৃতি থেকে জন্ম নেয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইসলামী ঐতিহ্য, ইতিহাস ও কৃষ্টি থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, বাঙ্গালী মুসলমানের জন্য সম্পূর্ণ আত্মহননের এক বাঙ্গালীয়ানার ভূত, সেই ১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তানী আমল থেকেই মূর্খতা ও ফাঁপা গরিমা সহকারে সানন্দে কাঁধে বয়ে বেড়ানো আত্মপরিচয়হীন ও শিকরবিহীন, এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথাকথিত শহুরে, শিক্ষিত, মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও তাদের বর্তমান প্রজন্ম, ২০১৩ সালে যখন শাহবাগ আন্দোলনে, প্রথম আলো-ডেইলি স্টার, সমকাল, জনকন্ঠ, মার্কা হিন্দু ভারতীয় আগ্রাসনবাদের পক্ষের প্রচারক ও সহায়তাকারী দৈনিক পত্রিকা সমূহের এবং দেশের যাবতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের (পঞ্চম বাহিনী) রাতদিনের পরিকল্পিত প্রচারে মাতোয়ারা, তখনও সেই আন্দোলনের পিছনের ফ্যাসিস্ট এজেন্ডা বুঝতে আমার অন্তত: কোন সমস্যা হয় নাই।
আমার দেশের প্রথম পাতার আট কলামের বিখ্যাত শিরোনাম, “শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি” আমি টালমাটাল দিনগুলোর এক সন্ধ্যাবেলায় সহকর্মী সৈয়দ আবদাল আহমেদ আর জাহেদ চৌধুরীকে বেশ চমকে দিয়েই পেন্সিল দিয়ে লিখে দিয়েছিলাম। তারপর বিভ্রান্ত জনগণকে একাকী সাবধান করতে গিয়ে হেন বিপদ নাই যা পরিবার নিয়ে মোকাবেলা করতে হয় নাই। বিএনপি পন্থীদেরও আমার উপর সে কী রাগ! তাদের মধ্যে অনেকেই তো সুযোগ পেলে তখন ধূপধুনো নিয়ে শাহবাগে আরতি দিয়ে আসেন। অথচ আমি তখন পত্রিকা অফিসে বন্দী। সারাদিন লেখালেখি করি, রাতে মাটিতে ঘুমাই। শাহবাগে আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে প্রতিদিন জঙ্গী মিছিল চলছে। ওদিকে কারওয়ান বাজারের আশেপাশে হাসিনার মৃত্যদূতেরা গুম করার সুযোগের অপেক্ষায় সারাক্ষণ ঘুরছে। চার মাসের ধৈর্য পরীক্ষা শেষে, গুমে ব্যর্থ হয়ে শেখ হাসিনার পুলিশ ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সকালে সম্পাদকের অফিস থেকেই আমাকে দ্বিতীয় দফায় গ্রেফতার করলো। তিন সপ্তাহ পর ৫ মে, শাপলা চত্বরে চললো আলেমদের গণহত্যা।
জেল থেকে বের হলাম ২০১৬ সালের একেবারে শেষে। ২০১৮ সালে নির্বাসনে আসতে বাধ্য হওয়ার পর থেকে যখন শুনছি আর দেখছি, বাংলাদেশের বিরোধী দলীয় তাবৎ নেতারা প্রায় প্রতিদিন, প্রতি বক্তৃতায়, হাসিনার সরকারকে আজ ফ্যাসিস্ট বলছেন, তখন সেই সব অনিশ্চিত ও কোলাহলময় দিনগুলোর কথা মনে করে নিরানন্দ জীবনে বেশ আমোদই পাই। গৌরচন্দ্রিকা দীর্ঘ হয়ে গেল। কী আর করা? জানেনই তো বাঙ্গালী মুসলমানের স্মৃতিশক্তির উপর আমার কোন ভরসা নাই। বারে বারে তাই তাদের স্মৃতিশক্তির উপর জমে যাওয়া মরচেগুলো ঘসে ফেলে পরিষ্কারের চেষ্টা করি। ফ্যাসিবাদের মূল বিষয়ে ফিরে আসছি।
রাজনীতিতে শেখ মুজিবের উত্থান পেশীশক্তি দিয়েই হয়েছিল। লেখাপড়ার দৌড় ছিল যৎসামান্য। কলকাতায় তাকে হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীর প্রধান লাঠিয়াল হিসাবেই গণ্য করা হতো। পাকিস্তান জামানার চব্বিশ বছরের কালচক্রে শেখ মুজিবের মত চরিত্র আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উঠে এলে দলটি পেশীশক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দল থেকে ক্রমেই জঙ্গীবাদী চরিত্র পরিগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা আরম্ভ করলে, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের জঙ্গীবাদী রূপান্তর দেশে ও বিদেশে বৈধতা লাভ করে। পাকিস্তানীদের নৃশংস বাঙ্গালী গণহত্যার কাছে বিহারীদের প্রতি চালানো গণহত্যা চাপা পড়ে যায়। আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধকালিন মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী ইসলাম ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠির উপর পরিচালিত ইসলামবিদ্বেষপ্রসূত তাবৎ নৃশংসতার ইতিহাসকে, কলকাতাপ্রভাবিত বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মহিমান্বিত করে দেখানোর মোক্ষম সুযোগ সৃষ্টি হয়। মঞ্চ এবং টেলিভিশনের নাটকে ও চলচ্চিত্রে ইসলামের পরিচিত পোষাককে (টুপি, দাড়ি, ইত্যাদি) পৈশাচিকতার প্রতীক রূপে দেখানোর রীতিও শুরু হয়। দেশটির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একই ধারা আজ অবধি কেবল চলমানই থাকে নাই, ৯/১১ পরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বব্যাপী ইসলামোফোবিয়ার ভয়ংকর বিস্তারের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদীরা (মুসলমান এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ভূক্ত) ৯০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র থেকে ইসলামের আচার ও সংস্কৃতি নির্মূলের সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়েছে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের কর্তৃত্ববাদী চেহারা দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হতে আরম্ভ করে। মুক্তযুদ্ধকালিন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্রপতি বলা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজুদ্দিন আহমেদ ছিলেন যথাক্রমে, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিব বাংলাদেশে ফিরেই সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলেন এবং আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে একজন নামমাত্র রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিলেন। তাজুদ্দিন আহমেদকে অর্থমন্ত্রি করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের আগেই শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি দেয়া হয়েছিল। সেই উপাধি স্বাধীনতার পর অতি ক্ষমতাধর স্বৈরশাসকের আর ভাল লাগছিল না। শেখ মুজিব বনে গেলেন জাতির পিতা। পাকিস্তান আর ভারতে জাতির পিতা থাকলে, বাংলাদেশে থাকবে না, এটা হতে পারে না। আসল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে একটি অঘোষিত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। শেখ মুজিবের ভাগিনা শেখ মনি, সাধারণ মানুষের কাছে তৎকালিন মূর্তিমান দানববিশেষ যার কাজ ছিল বিহারীদের পরিত্যক্ত বাড়িঘর ও সম্পদ দখল, ঘোষণা করলেন, “আমরা আইনের শাসন চাই না, মুজিবের শাসন চাই”। শেখ মুজিবও তাল মিলিয়ে হুমকি দিলেন, “লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে সব সোজা করে দেব”। শেখ হাসিনার কুৎসিত ভাষার জন্মগত উৎস (Gene) কোথা থেকে এসেছে বুঝতে পারছেন তো? মুজিব মাঠে নামিয়ে দিলেন তার সরকারি খুনি বাহিনী, যার পোষাকী নাম ছিল “জাতীয় রক্ষী বাহিনী”। বিশ্বে মুজিবের বাংলাদেশ গুমখুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধের উদাহরণে পরিণত হলো। ওদিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগের হত্যা, নারী নির্যাতন, অসহায় জনগণের উপর বর্বর জুলুম তো চলছেই। সেই শেখ মুজিবের পূজা আজ আপনারা দিবারাত্র করে চলেছেন।
এলো ১৯৭৪ এর ভয়াবহ, নিদারুন দুর্ভিক্ষ। চাল নাই, আমরা একবেলা ভাত খাই। ঢাকার রাস্তায় কংকালসার মৃতদেহের সারি। সারা দেশে অনাহারে মৃতের সংখ্যা কয়েক লাখ। শেখ মুজিব ছাব্বিস হাজার মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছিলেন। দুর্ভিক্ষের মধ্যে রাজপরিবারে তখন আনন্দের বন্যা চলছে। দুই রাজপুত্র, শেখ কামাল আর শেখ জামালের বিয়ের জমকালো অনুষ্ঠান। সেই হাহাকারের দিনে, সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে শেখ পুত্রবধুদের ছবি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। জনগণ দু মুঠো অন্ন না পেয়ে কংকালসার হলে কি হবে, রাজপরিবারে তো বিরিয়ানীর অভাব নাই। রাষ্ট্রের সর্বত্র সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। জনগণ ভাবছে, হায়রে এই নাকি স্বাধীনতা! আজকের হাসিনার মত সেদিন শেখ মুজিবও বুঝেছিলেন ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে দেশ থেকে এখনই গণতন্ত্র বিদায় করতে হবে। জনগন পরিবর্তনের সুযোগ পেলে রক্ষা নাই।
রাবার স্ট্যাম্পের পার্লামেন্টে পাঁচ মিনিটে একদলীয় বাকশাল প্রবর্তন হয়ে গেল। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী থেকে রাতারাতি পাঁচ বছরের জন্য বনে গেলেন রাষ্ট্রপতি। কোন ভোটের দরকার হলো না। দেশে কোন দল থাকলো না, সকল মিডিয়া নিষিদ্ধ। গনতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা বাংলাদেশ, মুজিবের নির্দেশে হয়ে গেল একদলীয় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। তাও মুজিবের উচ্চাশা মিটলো না। মাত্র পাঁচ বছর মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হওয়া কি জাতির পিতার মানায়? স্তাবকের দল থেকে দাবি তোলানো হলো, জাতির পিতাকে আজীবন প্রেসিডেন্ট করতে হবে। ওদিকে দেশ যাচ্ছে রসাতলে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এগিয়ে এলো। আমি তখন বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকশালের ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে খবর পেলাম, ১৫ আগস্ট সকালে শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে সেখানেই তাকে “আজীবন প্রেসিডেন্ট” ঘোষণা করা হবে। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” ঘোষণা করা হয়েছিল, তাই “আজীবন প্রেসিডেন্ট” এর ঘোষণাও ওখান থেকেই হবে। কিন্তু, তুচ্ছ মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার পরিকল্পনা জানবে কেমন করে? ১৫ আগস্টের সূর্যোদয় শেখ মুজিব দেখতে পারেন নাই। তার আগেই একদলীয়, স্বৈরাচারী সরকারের অপশাসনে চরমভাবে ক্ষুব্ধ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হয়েছিলেন। অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সামরিক অফিসাররা কেউ ইসলামপন্থী ছিলেন না, তারা সকলেই একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত। সেই সামরিক বিপ্লবের সঠিক, নিরপেক্ষ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণ যে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে হয় নাই এটা জাতি হিসেবে আমাদের দূর্বলতা ও সত্যবিমূখতাই প্রমাণ করে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন তারা অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি সযতনে এড়িয়ে গেছেন। ফলে একজন অতি অহংকারী, ফ্যাসিস্ট শাসক, শেখ মুজিব বিনা বাধায় বাংলাদেশে মহামানব বনে গেছেন। সঠিক ইতিহাস উন্মোচনের মাধ্যমে জাতির এই দায় থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে।
শেখ মুজিবের চরিত্রের আলোকে অতি সহজেই শেখ হাসিনার চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ, রক্তপিপাসু, লোভী, কুৎসিত ও ইতর রূপটি আমরা খুঁজে নিতে পারি। তার শারীরিক ভাষা, বাচনভঙ্গী এবং বক্তব্যে কোনরকম শালীনতা যে খুঁজে পাই না তাতে বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ আমি অন্তত: দেখি না। শুধু শেখ হাসিনার কেন, শেখ মুজিব পরিবারের কোন ব্যক্তির মধ্যে এই শালীনতা বোধ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কথিত বিশিষ্ট আইনজীবী এবং শেখ মনির পুত্র, ঢাকার এক অংশের মেয়র, ব্যারিস্টার তাপসের একটি বক্তব্য নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর আমি ওটা দেখেছি। কে বলবে লোকটা আদৌ কোন লেখাপড়া জানে? এটাই শেখ মুজিবের পুরো বংশের “ডি এন এ” কিংবা “জিন” এর প্রতিচ্ছবি। আপনাদের আবারও পুরনো উদাহরণ দেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক বিপ্লবে এই শেখ তাপসের পিতা শেখ মনিও নিহত হয়েছিলেন। সেদিন ঢাকার মানুষ লাইন ধরে গিয়ে তার লাশের উপর থুতু নিক্ষেপ করেছিল। লোকটির উপর মানুষের ঘৃনার মাত্রা বুঝতে পারছেন? নতুন প্রজন্মকে এই সব ইতিহাস না জানাতে পারাটাই আমাদের প্রজন্মের ব্যর্থতা।
আজকের সম্পাদকীয়তে অতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে, শেখ হাসিনার গতকালের সংবাদ সম্মেলনে আমি যে মূল বার্তা পেয়েছি সেটি অতি সংক্ষেপে এবার উল্লেখ করছি:
১। শেখ পরিবার বাংলাদেশের মালিক এবং শেখ হাসিনা নিজে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সম্রাজ্ঞী।
২। তিনি ইচ্ছা করলেই রাষ্ট্র অথবা নাগরিকের সকল সম্পত্তি (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্যসেবা, লেখাপড়ার ব্যবস্থা, বাসস্থান, ইত্যাদি) জনগণের ব্যবহারের জন্য যে কোন মুহূর্তে বন্ধ করে দিতে পারেন। তার দলের মহাসচিব ওবায়দুল কাদের ২০০৬ সালে বঙ্গভবনে অক্সিজেন বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা সারা দেশের অক্সিজেন বন্ধ করার ক্ষমতা রাখেন কিনা সেটা খোলাসা করেন নাই।
৩। তিনি ইচ্ছা হলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রাখতেও পারেন, অথবা দিল্লি কিংবা বেইজিং বা মস্কোকে দিয়ে দিতে পারেন অথবা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করতে পারেন। রাষ্ট্র যেহেতু তার বাবার, অতএব এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার একমাত্র তারই।
৪। বাংলাদেশ প্রকৃতই ভয়ানক অর্থনেতিক বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে। ১৯৭৪ সালের পরিস্থিতিতে আমরা নিপতিত হচ্ছি কিনা সেটা আল্লাহই ভাল জানেন।
৫। শেখ হাসিনা তার পিতাকে পেরিয়ে বাংলাদেশকে নর্থ কোরিয়ার মডেলে, ঘোষিত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করবার চিন্তাভাবনা করছেন। শেখ মুজিব সোভিয়েট ইউনিয়ন মডেল পর্যন্ত চিন্তা করেছিলেন।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের মাধ্যমে নিজের অজান্তে শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালে ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা, বাকশাল উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত সামরিক বিপ্লব এবং তার পিতার রক্তাক্ত মৃত্যুর যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। পৃথিবীর কোথাও কোন ফ্যাসিস্ট শাসকের শান্তিপূর্ণ অপসারণ ঘটে নাই। দুই কন্যা ছাড়া শেখ মুজিবের সপরিবারে মৃত্যু অবাঞ্ছনীয় হলেও ইতিহাসেরই নির্মম বিধান। আমরা এখনও আশা করতে চাই যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপেশাদারিত্ব, দেশপ্রেমহীনতা ও অপরিসীম বস্তুবাদী লোভ, বিরোধী রাজনৈতিক দলসমুহের কাপুরুষতা ও আপসকামিতা এবং ভূক্তভোগী জনগণের অবিশ্বাস্য নির্লিপ্ততার সুযোগে ১৫ বছর ধরে সম্পূর্ণ জবাবদিহিতাবিহীনভাবে রাষ্ট্র চালিয়ে অভ্যস্ত, অর্থ ও ক্ষমতার মোহে উন্মত্তপ্রায়, শেখ হাসিনা পিতার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ রাখবেন। নিয়তি আপনার পিতাকে ছেড়ে দেয় নাই। আল্লাহর দুনিয়ায় ফাসাদ তৈরী করে আপনিও পার পাবেন না। তিনি তার সময়মত জালিমকে পাকরাও করবেন।
লেখক: মাহমুদুর রহমান
সম্পাদক, আমার দেশ
সংগৃহীত